জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩: তিন অঙ্কের ভরসা

শহরের এক কোণে বসে লিখছি। জানালার বাইরে হালকা বৃষ্টি টুপটাপ শব্দ। আমার টেবিলে একটা পুরোনো নোটবই, তার ওপর কালো কালি-দাগ। এমন সময়ে হঠাৎ মনে হলো রাষ্ট্র আসলে কেমন? বড় বড় ভাষণের মতো? নাকি রাত তিনটায় নিঃশব্দে জেগে থাকা এক নম্বর, যেটাতে ফোন করলে কেউ “হ্যালো” বলে ওঠে?

আমাদের দেশে এমনই এক নম্বর আছে ৩৩৩। তিনটা অঙ্ক, অথচ ভেতরে আছে মানুষের দীর্ঘশ্বাস, প্রশাসনের ব্যস্ততা, আর প্রযুক্তির নীরব অ্যালগরিদম।

কল সেন্টারের ইতিহাসটা যদি বলি, মনে হয় পুরোনো একটা রেডিওর ফিতা ধীরে ধীরে ঘুরে খুলছে। লন্ডনে ১৯৩৭ সালে যখন ৯৯৯ চালু হলো, তখন পৃথিবী প্রথম শিখল বিপদে পড়লে রাষ্ট্র আসলেই হাত বাড়ায়। পরে আমেরিকার ৯১১ একই পাঠ আরেকটু জোরে শোনাল। কিন্তু মানুষ কি শুধু আগুন নেভানো আর ডাকাত ঠেকানোর মধ্যেই বাঁচে? না, মানুষের জীবন তো আরো জটিল, আরো ছোট ছোট কষ্টে ভরা। জন্মনিবন্ধনের কাগজ কোথায় করব, ভাতার আবেদন কেন আটকে আছে, বাজারে হঠাৎ দাম কেন বেড়ে গেল, পাশের বাড়িতে বাল্যবিবাহ হচ্ছে কিনা এসব ছোট ছোট যন্ত্রণা হয়তো জীবন কাড়ে না, কিন্তু জীবনকে ভারী করে তোলে। এই যন্ত্রণাগুলোও রাষ্ট্রের কানে পৌঁছানো দরকার।

তাই বাংলাদেশের দরকার হলো দুটো আলাদা দরজা। এক দরজা ৯৯৯ জীবন-মৃত্যুর জরুরি সংকটে রাষ্ট্রের হাহাকার করা সাড়া। আরেক দরজা ৩৩৩ যেখানে প্রতিদিনের নাগরিক দুঃখ-কষ্ট, ক্ষুদ্র অভিযোগ, অনিয়ম, অনিশ্চয়তার শব্দ রাষ্ট্র শুনতে পায়। এ যেন জরুরি আর নন-জরুরি দুটি ভিন্ন নদীর ধারা, কিন্তু শেষমেশ একই সাগরে মেশে আস্থার সাগরে।

ষাটের দশকে ইনবাউন্ড কল সেন্টার কাজ শুরু করেছিল, সত্তরের দশকে রকওয়েলের অটোমেটিক কল ডিস্ট্রিবিউটার শৃঙ্খলার বাঁশি বাজাল। এরপর আর শুধু কল নয় চ্যাট, ই-মেইল, সামাজিক মাধ্যম সব মিলে কনট্যাক্ট সেন্টার হলো এক বিশাল উঠোন। উঠোনে এলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ভয়েস বায়োমেট্রিকস, রিয়েল-টাইম ডেটার ঝটপট বিশ্লেষণ।

এই ইতিহাসের স্রোত ধরে জন্ম নিল আমাদের ৩৩৩। তিন অঙ্কের একটি নম্বর, দরজার ওপাশে কেউ ধৈর্য ধরে বলে “জি, বলুন।” জরুরি হোক বা নন-জরুরি মানুষের কণ্ঠস্বর রাষ্ট্রে পৌঁছে যায়। ৯৯৯ যেখানে জীবন রক্ষা করে, ৩৩৩ সেখানে জীবনকে সহজ করে। দুটি নম্বরই হয়ে উঠেছে আমাদের ভরসা, আমাদের আস্থার প্রতীক।

ডিজিটাল সার্ভিস ডেলিভারি ম্যাচুরিটি শুনতে কি স্কুলের পরীক্ষার মতো লাগে না? চারটা ধাপ প্রাথমিক, ইন্টিগ্রেশন, ট্রান্সফরমেশন, ইনোভেশন। কথাগুলো জটিল; কিন্তু অর্থ খুব সোজা। কাগজ-কলমের জীবনটা ধীরে ধীরে কম্পিউটারের স্ক্রিনে উঠে আসে; এরপর স্ক্রিন থেকে ডেটায়; তারপর ডেটা থেকে আগাম অনুমানে।
৩৩৩ এই সিঁড়িটা ধীরে ধীরে উঠছে। কেউ তাকে ঠেলাঠেলি করছে না; সে নিজেই হাঁটছে একটু থামে, শ্বাস নেয়, আবার হাঁটে। রাষ্ট্রের ব্যাপারগুলো এমনই হয় ধৈর্য দরকার।

মাত্র দেড় বছরে দুই কোটিরও বেশি কল এসেছে ৩৩৩-এ। প্রতিদিন প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ ভরসা করছে এই নম্বরে। সংখ্যা শুনলে অবাক লাগে বটে, কিন্তু আসল গল্পটা সংখ্যার ভেতরে নেই লুকিয়ে আছে মানুষের মুখের রেখায়, দীর্ঘশ্বাসে, ছোট্ট হাসিতে।

মাদারীপুরের সেই বৃদ্ধের কথা ভাবলে মনে হয়, রাষ্ট্র আসলে কাগজ নয়, মানুষের পাশে দাঁড়ানো এক অদৃশ্য হাত। নাতিকে বলেছিলেন “৩৩৩-এ দাও।” বহু বছরের ভাতার ক্লান্তি শেষে এক কলেই কাজ এগিয়ে গেল। কল কেটে তিনি দরজায় দাঁড়ালেন, বৃষ্টির শব্দ থেমে গেছে। ফিসফিস করে বললেন “রাষ্ট্র আমার পাশেই।”

গাইবান্ধার এক মা, রাত তিনটায় মেয়ের কপালে হাত রাখলেন। কপাল জ্বলছে। ঘরে ওষুধ আছে, কিন্তু আশ্বাস নেই। হঠাৎ ফোনের ওপাশে এক কণ্ঠ “ভয় পাবেন না।” তিনটি শব্দ তখন পুরো পৃথিবীকে ছোট করে ফেলল, একটা মায়ের বুক ভরে উঠল স্বস্তিতে।

আর কক্সবাজারের সেই গৃহিণী বাজারে গিয়ে দেখলেন চালের দাম আকাশছোঁয়া। বিরক্ত ভ্রু কুঁচকে ফোন তুললেন ৩৩৩-এ। কয়েক দিনের মধ্যেই প্রশাসনের লোকেরা হাজির হলো, দাম কমল। তাঁর মুখের হাসিটাই প্রমাণ করে “রাষ্ট্র” শব্দটা কেবল বইয়ের পাতায় নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কাছাকাছি একটা সত্তা।

আজকের ৩৩৩ যেন এক জাদুর বাক্স। এর স্লোগান “তথ্য ও সেবা সবসময়।” বাক্স খুললেই পাওয়া যায় হাজারো দরকারি জিনিস:
সামাজিক সুরক্ষা: বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের ভাতা, চিকিৎসা সহায়তা।
সনদ ও পরিচয়: জন্ম ও মৃত্যু সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টের নির্দেশনা।
অভিযোগ: বাজারদরের কারসাজি, পরিবেশ দূষণ, বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন সবই শোনা হয় ধৈর্য ধরে।
সিটি ও ইউটিলিটি: বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশা নিয়ন্ত্রণ, ট্রেড লাইসেন্স।
পরিবহন ও BRTA: ড্রাইভিং লাইসেন্স, নবায়ন, মালিকানা হস্তান্তর।
স্বাস্থ্য–দুর্যোগ: ভ্যাকসিনের তথ্য, সাইক্লোন বা বন্যার ত্রাণ ও উদ্ধার।
ডিজিটাল সেবা: একপে, ই-টিকিটিং, কর, ভ্যাট, ই-টিআইএন সব এক দরজায়।

বলতে গেলে, ৩৩৩ আসলে সেই বন্ধুর নাম যে কখনো ক্লান্ত হয় না, রাগ করে না। শুধু শোনে, বোঝে, আর নরম গলায় বলে “জি, বলুন।” ৯৯৯ জীবন বাঁচায়, ৩৩৩ জীবনকে সহজ করে। দুইটা মিলে রাষ্ট্রকে করে তোলে মানুষের ঠিকানা।

৩৩৩-কে আমি একটা জানালার সঙ্গে তুলনা করি। যে জানালা দিয়ে রাষ্ট্র নাগরিককে দেখে, নাগরিকও রাষ্ট্রকে।
প্রতিটি কল আসলে একটি ছোট্ট বিন্দু ডেটা পয়েন্ট। বিন্দুগুলো জোড়া লাগালে দেখা যায় কোথায় বাল্যবিবাহ বেশি, কোন জেলায় বাজারদরের অভিযোগ ভিড় করছে, কোথায় ড্রেনেজ সমস্যা ঘুম কাড়ছে। সরকার চাইলে এই বিন্দু-মানচিত্র দেখে আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এটাই ডেটা-চালিত নীতি শব্দটা বড়, কাজটা ছোট ছোট। একেকটা কল, একেকটা মানুষের কথা, সব মিলিয়ে একটা দেশের ছবি।

রাষ্ট্রেরও লাভ আছে কাগজপত্রের দৌড়ঝাঁপ কিছুটা কমে, অফিসের ভিড় সামলায় ফোনের ওপাশের কণ্ঠ। স্বচ্ছতা বাড়ে কোন কল কখন এসেছে, কী কথা হয়েছে, কোথায় পাঠানো হয়েছে সবই রেকর্ডে। জবাবদিহির জন্য এগুলো ভালো ওষুধ।
আর নাগরিক? সে তো সমতার দরজা পায়। শহরের ব্যস্ত অফিসকর্মী বা নীলফামারীর কৃষক একই নম্বরে একই মর্যাদা। ইন্টারনেট না থাকলেও ভয়েস থাকে ভয়েসই প্রযুক্তি হয়ে যায়।

তবে একটা বিষয় আছে আমরা মাঝে মাঝেই পথ হারাই। ৯৯৯-এ কোনটা যাবে, ৩৩৩-এ কোনটা এই প্রশ্নে অনেকেই ধন্দে পড়ে।
আমার মনে হয়, দরকার একটু সোজাসাপ্টা নিয়ম। জীবনঝুঁকি দ্রুত ৯৯৯। বাকি দৈনন্দিন সমস্যা ৩৩৩। ভুল হলে উষ্ণ হস্তান্তর “ভাই, এই কল আমি ৯৯৯-এ পাঠিয়ে দিলাম, আপনার নামটা বলে যান।” এভাবে বললে নাগরিক বিভ্রান্ত হয় না, আস্থাও নষ্ট হয় না।

আমাদের দেশে সময়ের ধারণা একটু ঢিলেঢালা। তবু সেবা যদি সময়ের মধ্যে আসে, মানুষ খুব খুশি হয়। তাই ৩৩৩-এর পাশে আমি একটি ছোট বোর্ড ঝুলিয়ে দিতে চাই
প্রথম সাড়া: কত ঘণ্টা।
সমাধান: কত দিনে।
জেলা-সিটি-উপজেলা ধরে এই সময়গুলো যদি নিয়ম করে লেখা থাকে, আস্থা বাড়ে। মানুষ অপেক্ষা করতেও রাজি, শুধু জানাতে হবে, “আপনার কেসটা In-Progress।”

আরেকটা বিষয় কেস-আইডি। নামটা শুনতে সিনেমার মতো; কিন্তু কাজে খুব। এসএমএসে যদি লেখা আসে “Received → In-Progress → Resolved”, চোখের সামনে যেন একটা সরু রাস্তা তৈরি হয় কণ্ঠস্বরের যাত্রাপথ।

বাংলাদেশ অনেক রঙের দেশ ভাষা, উচ্চারণ, হাবভাব। তাই প্রতিটি জেলায় যদি স্থানীয় ফর্ম, ফি, সময়সূচি, অফিস-লোকেশন সব মিলিয়ে একটা ছোট্ট জ্ঞানভাণ্ডার থাকত! আঞ্চলিক ভাষায় দুটি শব্দ বেশি হলেই ফোনের ওপাশে মানুষটা একটু বেশি স্বস্তি পায়।
অভিযোগ দিলে প্রমাণও তো দরকার একটা ছবি, লোকেশন, কোনো রসিদের কপি। ড্যাশবোর্ডে এগুলো উঠলে মাঠের লোকেরা দ্রুত বুঝে ফেলে কোথায় যেতে হবে, কার দরজায় কড়া নাড়তে হবে।

স্বচ্ছতা নিয়ে আমার দুর্বলতা আছে। মনে হয়, একটা খোলা জানালা না থাকলে ঘরে বাতাস ঢোকে না। ৩৩৩-এরও দরকার তেমন জানালা পাবলিক ড্যাশবোর্ড।
মাসে মাসে বলা যাক কত কল এল, কতটার সমাধান হলো, গড় সময় কত। “সমস্যা আছে” এই বাক্যটা লুকোতে হবে না। বরং দেখাতে হবে “সমাধানও হচ্ছে।” রাষ্ট্রের সৌন্দর্য এখানেই সে ভুল করে, শোধরায়, আবার হাঁটে।

ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু স্বপ্ন দেখি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসবে ভয়ের কিছু নেই। সহজ প্রশ্নের উত্তর বট দেবে, জটিল কেসে মানুষ। এজেন্টরা তখন আরও মানবিক কথোপকথনের জন্য সময় পাবে। দুর্যোগ হলে স্কেল-আপ অতিরিক্ত ফ্লোর খুলে যাবে, ব্যাকআপ সেন্টার জ্বলে উঠবে।
ফোনের পাশাপাশি চ্যাট, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভিডিও কল সব দরজা খোলা থাকবে, কিন্তু নলেজবেজ একটাই। এক জায়গায় উত্তর ঠিক থাকলে সব জায়গাতেই ঠিক থাকবে এটাই নিয়ম।

১০

পরিবেশের গল্পও আছে ইটভাটা, দূষিত ড্রেন, কারখানার ধোঁয়া। কেউ ৩৩৩-এ বলেছিল, “শিশুরা ঘুমাতে পারছে না।” কয়েক দিনের মধ্যে ব্যবস্থা শিশুর ঘুম ফেরে। এই একটুখানি ঘুম রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

১১

সবশেষে একটা কথা। আমরা যখন “নতুন বাংলাদেশ” বলি, তখন আসলে নতুন মানুষ, নতুন রাষ্ট্র, দুজনেরই কথা বলি। ৩৩৩ সেই মিলনের জায়গা এখানে প্রযুক্তি কেবল যন্ত্র না, মানুষের সেবায় নম্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
Maurício França বলতেন সেবার মূল হলো সম্পর্ক। Paulo Vandor বলতেন ডেটা ভবিষ্যতের জ্বালানি। Fabio Zaffalon বলতেন কৌশল আর প্রযুক্তির সঠিক মেলবন্ধনই সাফল্য।
আমার নিজের কথাটা খুব ছোট রাষ্ট্র মানে দূরের কেউ নয়; রাষ্ট্র মানে ফোন ধরার পর যে বলে, “জি, বলুন।”

৩৩৩ তাই কেবল একটি নম্বর না, এক নিঃশব্দ সঙ্গী। ক্লান্ত হলে শোনে, দুর্বল হলে সাহস দেয়, ভুল হলে পথ দেখায়।
বৃষ্টিটা যেন আবার টুপটাপ শুরু হলো। জানালাটা একটু খুলে দিলাম। মনে হলো, দেশের ওপর দিয়ে হালকা একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছে এক নম্বরের ভরসা নিয়ে।

লেখক পরিচিতি

দিদার-ই-কিবরিয়া
জুনিয়র কনসালট্যান্ট (৩৩৩), Aspire to Innovate (a2i), আইসিটি বিভাগ
 ই-মেইল: didar.kibria@a2i.gov.bd

দিদার-ই-কিবরিয়া আইসিটি বিভাগের অধীনে পরিচালিত Aspire to Innovate (a2i) কর্মসূচির একজন প্রযুক্তি ও শাসনব্যবস্থা বিষয়ক পেশাজীবী। তিনি ডিজিটাল সেবা উদ্ভাবন, নাগরিককেন্দ্রিক সিস্টেম নির্মাণ, এবং জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ এর মতো কল সেন্টার প্ল্যাটফর্মের রূপান্তর নিয়ে কাজ করেন। তাঁর গবেষণা ও কর্মজীবনের মূল লক্ষ্য সহমর্মিতা, ডেটা, ও প্রযুক্তির সমন্বয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সেবার মানোন্নয়ন এবং নাগরিকের আস্থা পুনর্গঠন করা।

 

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *